ঢাকা ১৮ অক্টোবর, ২০২৪
সংবাদ শিরোনাম
ঈদ ও পূজার ছুটি বাড়ল আশুলিয়ায় পুলিশের অভিযানে ১ ট্রাক পলিথিনসহ ২ জন আটক আশুলিয়ায় সড়ক অবরোধ করে শ্রমিকদের কর্মবিরতি ৪৩তম বিসিএসের নিয়োগ প্রজ্ঞাপন বাতিলের দাবি বিএনপির ৪৬ রানে অলআউট, দেশের মাঠে সর্বনিম্ন রানের লজ্জায় ভারত মানুষের মাঝে কোনো বৈষম্য থাকবে না: জামায়াত আমির সিরাজগঞ্জে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৩ সেপ্টেম্বরে সড়কে ঝরেছে ৪৯৮ প্রাণ: যাত্রী কল্যাণ সমিতি শেখ হাসিনা-ওবায়দুল কাদেরের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি বিমানবন্দর থেকে শমসের মবিনকে ফেরত

বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম: স্মৃতি কথা

#

৩১ অক্টোবর, ২০২৩,  4:07 PM

news image

-প্রফেসর ড. এম. শমশের আলী-


তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে ডাক পেলাম তাঁর সাথে দেখা করার জন্য। উনি আমাকে বাউবি স্থাপনের দায়িত্ব নিতে বললেন এর ভাইস-চ্যান্সেলর হিসেবে। শীঘ্রই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব সাহাজুদ্দিন সাহেবের কাছ থেকে একটা নিয়োগপত্র পেলাম। আসলে নিয়োগপত্রটা বাউবির ভাইস-চ্যান্সেলর হিসেবে হলেও আমি একসাথে প্রকল্প পরিচালকের কাজও করতে লাগলাম। এটি ছিল এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের একটি ১৮০ কোটি টাকার প্রজেক্ট (যা পরবর্তীতে বেশ কিছুটা বর্ধিত হয়)। বাউরি আইন তখনও পরিণত হয়নি। বাউবি আইন পরিণত হয় ১৯৯২ সালের অক্টোবর মাসে। তাই আমার কার্যকাল ছিল ৫ বছর (প্রকল্প পরিচালক ও ভাইস-চ্যান্সেলর হিসেবে)। গোড়াতে একেবারে শূন্য হাতে শুরু করতে হয়েছিল। আমি নিয়োগপত্র পেয়ে সাহাজুদ্দিন সাহেবকে জিজ্ঞাস করলাম, আমি বসবো কোথায়?, লোকবল তো লাগবে। উনি বললেন, সেটা আপনি ঠিক করুন। বললাম, কী কী বিষয়ের ওপর জোর দেব? উনি আবারও বললেন, প্রকল্পের কাগজপত্র দেখে অগ্রসর হবেন। বুঝলাম এসব জিজ্ঞেস করে কোনো লাভ হবে না, সব উদ্যোগ নিজেকেই নিতে হবে। কিছুদিনের মধ্যেই ধানম-ি ২নং রোডে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর মমতাজ উদ্দিন সাহেবের কন্যা তাঁর একটি বাড়ি সানন্দে আমার প্রকল্প অফিস হিসেবে ব্যবহার করার জন্য সরকারের সাথে চুক্তিবদ্ধ হলেন। বর্তমানে ধানম-ি ২নং রোডের বিপরীতে অবস্থিত এই অফিসটি এখন পরিণত হয়েছে স্টার কাবাব রেস্টুরেন্টে। অনেকগুলো আঞ্চলিক কেন্দ্র ও স্টাডি সেন্টার বানাতে হবে এটা ছিল অন্যতম কাজ। এসব নির্মাণ কাজে তো কয়েক বছর লেগে যাবে। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃশ্যমানতা কী করে তাড়াতাড়ি দেখাতে পারব, এসব নিয়ে বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম। সে সময় বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আমি কিছু ক্লাস নিতাম। সেখানে সিনিয়র এক নারী অফিসার বললেন, জেনারেল এরশাদের সময় প্রতিটি উপজেলা কার্যালয়ে দুটি করে রুম ও একটা করে অডিটোরিয়াম তৈরি করা হয়েছিল। এই সরকার উপজেলার পরিবর্তে থানা শব্দ ব্যবহার করছে, কিন্তু ওই অবকাঠামো তো রয়েই গেছে। দেখুন না এগুলো ব্যবহার করতে পারেন।' আমি ভদ্রমহিলাকে ধন্যবাদ দিয়ে বাসায় ফিরেই তৎকালীন এলজিআরডি মন্ত্রী আব্দুস সালাম তালুকদার সাহেবকে ফোন করলাম। উনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনার উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কেমন চলছে? আমি সরাসরি বললাম, আমি আপনার সঙ্গে একটি জরুরি সাক্ষাৎ চাই, কিন্তু এটি হবে একটু অন্যরকম। এই সাক্ষাতের সময় আপনার সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব, উপ সচিব এবং দরকার হলে সেকশন অফিসারকে রাখবার জন্য আমি বিনীত অনুরোধ করছি। উনি বললেন, এরকম মিটিং তো আমরা কখনও করি না। আমি বললাম, একটি বিশেষ কারণে আমি এই অনুরোধটা করছি, আপনি অনুরোধটা রাখেন। উনি বললেন, আচ্ছা, আসেন। নির্ধারিত দিনে গেলাম। গিয়ে দেখি সত্যিই হাউজফুল, যেমনটি চেয়েছিলাম। কোনো ভূমিকা না রেখেই মন্ত্রী মহোদয়কে বললাম, বাউবি প্রজেক্টে যে আঞ্চলিক কেন্দ্র এবং স্টাডি সেন্টার-এর কথা আছে সেগুলো করতে অনেক সময় লাগবে। আমার বিনীত অনুরোধ উপজেলায় অর্থাৎ বর্তমান থানা অফিসগুলোতে যে অবকাঠামো আছে এগুলো দয়া করে বাউবি-কে ব্যবহার করার অনুমতি দেন, আমি এক্ষুনি কাজ শুরু করতে চাই। তখন উনার সচিব মহোদয় বলে উঠলেন 'সরকারি কোনো এজেন্সিগুলো ব্যবহার করলেও বিনে পয়সায় করতে পারবে না। আপনারা টাকা পাবেন কোথায়?” আমি বললাম ১৮০ কোটি টাকা আমাদের আছে। মন্ত্রী মহোদয় সচিব মহোদয়কে একটু কড়া সুরেই বললেন 'রাখেন তো আপনার এই সব খরচ-পাতির কথা, উনি যা করছেন তা কি নিজের জন্যে করছেন নাকি দেশের জন্যে করছেন? বাউবি তো বাংলাদেশ সরকারের একটা অগ্রাধিকার প্রকল্প। উনাকে কাজ করতে দেনা। ধীরে ধীরে বাউবির আইনে বাউবি-র সাথে বাইড একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরপর সরকারের অনুমতি নিয়ে উন্নত ধরনের ইএনজি ক্যামেরা কেনা হলো, ছোট-খাটো একটি এডিটিং প্যানেলও ঠিক করা হলো। বি.এড. এর জন্য কিছু ধঁফরড় audio visual program তৈরি করা হলো। ইংরেজি শিক্ষা ও গণিত শিক্ষার ওপর কিছু অনুষ্ঠান তৈরি করা হলো সম্প্রচার করবার জন্যে। রেডিও টেলিভিশন থেকে কিছু সময় নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে টিভি অনুষ্ঠান প্রচারের উদ্বোধন করলাম। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরমাল এবং ইনফরমাল টিভি প্রোগ্রাম লোকে দেখতে শুরু করল, আনন্দ পেল এবং এর প্রচার ঘটল। শিক্ষামন্ত্রী একদিন আমাকে বললেন, “আপনি দেখছি প্রোগ্রাম শুরু করে দিয়েছেন বাউবি’র আইন প্রণয়নের আগে”। আমি বললাম, হ্যাঁ স্যার আমি একটি বহুমুখী অ্যাটাকের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েছি। 

সরকারের নির্দেশে আইন মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিবের সহায়তায় প্রতিদিন ২ থেকে ৩ ঘণ্টা সময় আমি তার পাশে একটা চেয়ারে বসে আইন প্রণয়নের কাজে কাটাতাম। ইতোমধ্যে একদিন আমি প্রখ্যাত সংগীতকার মৃত খন্দকার নূরুল আলমের সাথে বসে সারাদিন কাজ করে নজরুল ইসলামের 'আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে" এই কবিতাটির কয়েকটি চরণ সিগনেচার টিউন হিসেবে বেছে নিলাম এবং সংশ্লিষ্ট সকলকে দেখিয়ে সম্মতি পেলাম। এতে কিছু ভিজ্যুয়াল শট থাকল। এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটা লোগো তৈরির ইতিহাসটাও বলতে চাই। আমার নিজের প্রবল ইচ্ছে ছিল এটা ইংরেজি এবং আমাদের মাতৃভাষা বাংলা দুটোতেই হবে। অর্থাৎ BOU এবং বাউবি এ দুটো এক সাথে থাকবে। আল্লাহর মর্জি অনেক চিন্তা করার পর সেটা করতেও পারলাম। Canada Athabasca Open University র লোগো দেখে এ কাজটা করতে আমি উৎসাহিত হয়েছিলাম। পরবর্তীতে এদেশের খ্যাতনামা শিল্পী মরহুম আব্দুল কাইয়ুম-এর সম্মতিতে এটিই হয়ে গেল বাউবির লোগো। লোগোটি ডিজাইন করেছিলেন বাউবির তৎকালীন দক্ষ আর্ট অফিসার ই.জেড.এম. মাসুদ মাহমুদ মল্লিক। বাউবি নিয়ে শত শত গল্প, হাজারো স্বপ্ন আছে আমার।

বাউবির প্রকল্প পরিচালক এবং ভাইস-চ্যান্সেলর হিসেবে আমার ৫ বছর দায়িত্ব পালনের শেষে ১৯৯৬ সালে আমি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে আসি। আজকে আমি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, কর্মচাঞ্চল্য এবং কর্মপাগল না হলে কোনো সৃষ্টিশীল কাজ হয় না। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাক্ষেত্রে একটি নীরব বিপ্লব সাধন করেছে। এর সার্থকতা টিকিয়ে রাখতে হলে আপনারা অবশ্যই দেখবেন পরীক্ষা যেন একদম ঠিক সময়ে হয়, ফলাফল যেন অতিসত্তর প্রকাশ করা হয়, স্টাডি সেন্টারের উপকরণগুলো যেন একদম ঠিক সময়ে পৌঁছায়, শিক্ষকরা তাঁদের কাজ যেন ঠিকমতো করেন এর তত্ত্বাবধান যেন কড়াকড়িভাবে করা হয়। আমি বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় এর অপার সম্ভাবনা এবং গৌরবোজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করে আমার স্মৃতিচারণ এখানেই শেষ করছি।

-প্রফেসর ড. এম. শমশের আলী
প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য,
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
ও প্রফেসর ইমেরিটাস, সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটি।


logo

সম্পাদক ও প্রকাশক : মো. নজরুল ইসলাম