
NL24 News
২৮ জুলাই, ২০২৫, 11:22 AM

৫ বছরে সর্বনিম্ন এলসি খোলার পরিমাণ জুনে
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের প্রতিবেদন
দেশে বেসরকারি বিনিয়োগে মন্দা, মূল্যস্ফীতি, মজুরি বৃদ্ধির সমন্বয় না থাকা এবং ভোগব্যয় কমে যাওয়ার প্রভাবে আমদানির চাহিদা কমে গেছে। যার ফলে ৫৮ মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়েছে গত জুন মাসে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য থেকে এ চিত্র উঠে এসেছে।
এই পরিস্থিতিতে ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করে বলছেন, জুনে কোভিড মহামারির সময়ের চেয়েও কম এলসি খোলা হয়েছে। এটি আমদানিনির্ভর যেকোনো দেশের জন্য বিপৎসংকেত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, জুনে এলসি খোলার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪.১৪ বিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই মাসের তুলনায় প্রায় ২৪.৪২ শতাংশ কম। গত অর্থবছরের জুনে ৫.৪৭ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে এলসি খোলার পরিমাণ ক্রমাগত কমেছে। জুনে তা তলানিতে এসে ঠেকে। সর্বশেষ এরচেয়ে কম এলসি খোলা হয়েছিল ২০২০ সালের আগস্টে—৩.৭ বিলিয়ন ডলার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২০ সালের মার্চে দেশে প্রথম কোভিডে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার পর দেশব্যাপী লকডাউন ও অর্থনৈতিক স্থবিরতার কারণে সে বছর আমদানি কমে গিয়েছিল। তবে এ বছরের জুনে এলসি খোলা কমার কারণ হিসেবে বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার বিষয়টিই সামনে আসছে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, 'অনেক আমদানিকারক আমদানি অনেক কমিয়ে দিয়েছে। কারণ তারা তাদের পণ্যের চাহিদা কম বলে জানিয়েছে। এছাড়া সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিএপি) বাস্তবায়নের হারও অনেক কম।'
তিনি আরও বলেন, 'আমাদের মতো আমদানিনির্ভর দেশে আমদানি এভাবে কমে যাওয়াটা হতাশাজনক। এর ফলে সরকারের রাজস্ব আয় ও ব্যাংকের সামগ্রিক আয়ও কমে যাবে।'
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে (জুলাই-জুন) মোট আমদানি হয়েছে প্রায় ৬৯ বিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় মাত্র ০.১৮ শতাংশ বা ১২২ মিলিয়ন ডলার বেশি। তবে সব পণ্যে আমদানি বাড়েনি।
বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি খোলা এলসি আগের অর্থবছরের তুলনায় ২৫ শতাংশের বেশি কমেছে। একই সময়ে মধ্যবর্তী পণ্য, পেট্রোলিয়াম ও শিল্পের কাঁচামালের আমদানি এলসি খোলাও কমেছে। এই প্রবণতাকে অর্থনৈতিক গতিমন্থরতার লক্ষণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
জুনে কমেছে এলসি নিষ্পত্তিও
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, জুনে মোট ৪.৫৯ বিলিয়ন ডলারের এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে, যা এক বছর আগের একই মাসের ৫.৩৩ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় ১৪ শতাংশ কম।
সর্বশেষ চলতি বছরের জুনের চেয়ে কম এলসি নিষ্পত্তি করা হয়েছিল কোভিডকালীন ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে। ওই মাসে ৪.৪১ বিলিয়ন ডলারের এলসি নিষ্পত্তি হয়েছিল।
অবশ্য অর্থবছরের হিসাবে এলসি নিষ্পত্তি বেড়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৬৯.৪৬ বিলিয়ন ডলারের আমদানি এলসি নিষ্পত্তি করেছে, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরের ৬৬.০৭ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় ৪.১৮ শতাংশ বেশি।
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, 'সরকারকে আমদানি বাড়াতে খুব দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। এর জন্য ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাদা করে আলোচনায় বসা, তাদের প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করাসহ যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন করার দিকে মনোযোগ দিতে হবে।'
আমদানি কমায় ডলারের দরপতন
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, জুনে আমদানি অনেক বেশি কমে যাওয়ায় বাজারে ডলারের তারল্য বেড়ে গিয়েছিল। এর জের ধরে কমতে শুরু করেছিল ডলারের দাম।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহের শেষদিক থেকে ডলারের দাম কমতে শুরু করে। তখন মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে ডলারের দাম প্রায় ৩ টাকা কমে ১২০ টাকায় নেমে এসেছিল। এই পরিস্থিতিতে গত ১৩ জুলাই ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নিলামে ডলার কিনে বাজারে হস্তক্ষেপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ওই দিন নিলামের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১২১.৫০ টাকা দরে ১৭৩ মিলিয়ন ডলার কেনে, যদিও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ১২০ থেকে ১২০.৫০ টাকা দরে বিক্রির প্রস্তাব করেছিল। বেশি ফ্লোর প্রাইস দিয়ে ডলার কিনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার স্থিতিশীল করার ইচ্ছার জানান দেয়।
এর মাত্র দুই দিন পর, ১৫ জুলাই, একই দামে আরও ৩৭৩ মিলিয়ন ডলার কেনে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরের একটি নিলামে কেনা হয় আরও ১০ মিলিয়ন ডলার। এসব পদক্ষেপে ডলারের দরপতন থামে, মুদ্রাটির দাম ফের বাড়তে শুরু করে। রবিবার (২৭ জুলাই) রেমিট্যান্স ও আন্তঃব্যাংক বাজারে ডলারের দর ছিল ১২২.৫০ থেকে ১২২.৮৩ টাকা।
আমদানি এলসির চাহিদা না থাকা প্রসঙ্গে আরেকটি ব্যাংকের সিইও বলেন, 'বর্তমানে বিনিয়োগ হচ্ছে না বললেই চলে। আর বিনিয়োগ না হলে মূলধনী যন্ত্রপাতি বা কাঁচামালসহ অনেক আমদানি হয় না। এখন যা আমদানি হচ্ছে, তার একটা বড় অংশই নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য। ভোগ্যপণ্যের আমদানি সাধারণত একটা নির্দিষ্ট অবস্থানেই থাকে।'