জ্বরের যেসকল তথ্য জেনে রাখা ভালো
লাইফস্টাইল ডেস্ক
১৩ অক্টোবর, ২০২২, 2:23 PM
লাইফস্টাইল ডেস্ক
১৩ অক্টোবর, ২০২২, 2:23 PM
জ্বরের যেসকল তথ্য জেনে রাখা ভালো
হঠাৎ করে জ্বর এসেছে। এমন অভিজ্ঞতা কম-বেশি সবারই রয়েছে। অনেকের জ্বর ২ থেকে ৩ দিনে ভালো হয়ে যায়, অনেকই আবার দীর্ঘদিন ভুগেন জ্বরে। জ্বরের কারণে হাসপাতালে ভর্তির অভিজ্ঞতাও রয়েছে কারও কারও। বাংলাদেশে সাধারণত জ্বর হলে প্যারাসিটামল, নাপা জাতীয় ওষুধ খেয়ে ঘরে বসেই চিকিৎসা নেয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। কিন্তু চিকিৎসকরা বলছেন কোনো কোনো সময় জ্বর মারাত্মক প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে। চিকিৎসকদের মতে, জ্বরের অনেক প্রকারভেদ রয়েছে। কিছু কিছু জ্বর নিজে নিজেই ভালো যায়। আবার কিছু কিছু জ্বরের ক্ষেত্রে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত। শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যেতে শুরু করলে বা শরীরের উচ্চ তাপমাত্রাকে জ্বর বলে। মানুষের শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৯৮.৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শরীরের তাপমাত্রা এর বেশি হলেই তখন জ্বর বলা হয়ে থাকে। চিকিৎসকরা বলেন, জ্বর আসলে কোন রোগ নয়, বরং এটি রোগের একটি পূর্ব লক্ষণ বা উপসর্গ। ফলে জ্বর হওয়াকে শরীরের ভেতরের কোনো রোগের সতর্কবার্তা বলা যেতে পারে। অনেক সময় সেটা সর্দিকাশির মতো সাধারণ সংক্রমণের কারণে হতে পারে, আবার অনেক ক্ষেত্রে গুরুতর কোনো রোগের উপসর্গও হতে পারে।
যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, শরীরের ভেতরে যখন কোনো জীবাণু আক্রমণ করে, সেটা ঠেকাতে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বিভিন্ন কোষ থেকে পাইরোজেন নামক এক ধরনের পদার্থ নিঃসরণ করে তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে লড়াই করতে শুরু করে। এ কারণে জ্বরের অনুভূতি হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. তৌফিক আহমেদ বলেন, অনেকগুলো কারণে জ্বর হতে পারে। সবচেয়ে সাধারণ হল ঠাণ্ডা লেগে জ্বর হওয়া বা সর্দি-কাশির কারণে জ্বর। এর বাইরে শরীরের ভেতরে কোনো কারণে ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের আক্রমণ হলে, অর্থাৎ ইনফেকশন হলেও জ্বর হতে পারে। প্রোটোজোয়া বা ফাঙ্গাস ইনফেকশনের কারণেও জ্বর হতে পারে। যেকোনো ধরনের ম্যালিগনেন্সি বা ক্যান্সারের কারণেও জ্বর হতে পারে। তিনি আরও জানান, টিকা নিলে, ফোঁড়া বা টিউমার হলে, রিউমাটয়েড আথ্রাইটিস, প্রস্রাবের রাস্তায় ইনফেকশন হলে, পিরিয়ডের কারণে, আকস্মিক ভয় পেলে বা মানসিক আঘাত পেলেও জ্বর হতে পারে। করোনাভাইরাস, ডেঙ্গু, টাইফয়েড বা ম্যালেরিয়ার মতো রোগেরও প্রাথমিক লক্ষণ হল জ্বর আসা।
জ্বরের প্রকারভেদ:
চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় জ্বরকে সাধারণত তিন ভাগে ভাগ করা হয়।
কন্টিনিউড: কেউ জ্বরে আক্রান্ত হলে ২৪ ঘণ্টায় যখন শরীরের তাপমাত্রা এক ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বা ১.৫ ফারেনহাইট তারতম্য হয়, কিন্তু জ্বর পুরোপুরি স্বাভাবিক অবস্থায় আসে না, সেটাকে বলা হয় কন্টিনিউড জ্বর।
রেমিটেন্ট: যখন ২৪ ঘণ্টায় জ্বরের মাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ৩ ফারেনহাইটের মধ্যে তারতম্য হয়, সেটাকে বলে রেমিট্যান্ট জ্বর।
ইন্টারমিটেন্ট: যখন জ্বর দৈনিক কয়েক ঘণ্টা করে শরীরে থাকে, আসে এবং যায়, তখন তাকে বলে ইন্টারমিটেন্ট জ্বর।
কখন ডাক্তারের কাছে যেতে হবে?
ডা. তৌফিক আহমেদ বলছেন, ‘অনেক সময় জ্বরের কারণ রোগী নিজেই বুঝতে পারেন। যেমন বৃষ্টিতে ভেজার কারণে জ্বর এলে, ঋতু পরিবর্তনের সময় সর্দি-কাশির সঙ্গে জ্বর থাকলে-সেটা কয়েকদিন পরেই ভালো হয়ে যায়। এ ধরনের জ্বরে সর্দি, কাশি বা ঠাণ্ডা থাকে, সাধারণ জ্বর থাকে। এরকম জ্বরে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।’
‘কিন্তু কোনো কোনো জ্বরের কিছু আলাদা উপসর্গ দেখা যায়। হয়তো রোগীর ঘনঘন প্রস্রাব হচ্ছে বা প্রস্রাবে জ্বালা পোড়া হচ্ছে, পিঠের নিচের দিকে ব্যথা হচ্ছে, তখন আমরা ধারণা করতে পারি তার কিডনি বা প্রস্রাবের নালিতে হয়তো সংক্রমণ হয়েছে। এখন ডেঙ্গুর মৌসুম, কারও যদি প্রচণ্ড জ্বর থাকে, পেছনে সরাসরি ব্যথা, চোখ লাল- তখন হয়তো ডেঙ্গুর আশঙ্কা থাকে। এরকম অনেক উপসর্গ দেখা দিলে জ্বরের চিকিৎসা করতে হয় ।
তিনি আরও বলেন, ‘কোন দৃশ্যমান কারণ ছাড়াই যখন কারও জ্বর হয়, তখন সেটাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। কারণ সেটা গুরুতর কোন রোগের উপসর্গ হতে পারে। যদি দেখা যায় , একটানা অনেকদিন জ্বর থাকছে অথবা শরীরের তাপমাত্রা খুব বেশি হয়ে যাচ্ছে, তখন কোনো রকম দেরি না করে, দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত। তখন চিকিৎসক অন্যান্য লক্ষণ যাচাই করে জ্বরের কারণ নির্ধারণ করে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে থাকবেন।
ডেঙ্গুর মতো কিছু রোগের ক্ষেত্রে জ্বর হলে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত বলে মনে করেন ডা. আহমেদ। কারণ হিসেবে বলেন এসময় রোগীর রক্তের প্লাটিলেট কমে যায়। ফলে আক্রান্ত হওয়ার তিন দিনের মধ্যে পরীক্ষা করিয়ে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করে দিতে হয়।
জ্বরের সাথে ঘাড় বা শরীরের ব্যথা, উচ্চ তাপমাত্রা, বমি করা বা খাবার খেতে না পারা, তিনদিনের বেশি জ্বর থাকা, শুধু রাতে জ্বর আসা, শরীরে র্যাশ বের হওয়া, চোখ শুকিয়ে যাওয়া, খিচুনি হওয়া-ইত্যাদি লক্ষণ থাকলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা ।
ডাক্তারের পরামর্শ ছাড় ওষুধ খাওয়া কতটা ঠিক?
ডা. তৌফিক আহমেদ বলছেন, আমাদের দেশে প্রায় সকলেই জ্বর হলে নিজে নিজেই প্যারাসিটামল বা অ্যান্টিবায়োটিক জাতীয় ওষুধ খেয়ে থাকে। জ্বরের প্রথমদিকে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ অনেক সময় চিকিৎসকরা খাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিক জাতীয় ওষুধ কোন ক্রমেই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া খাওয়া উচিত নয়।
ডা. আহমেদ আরও বলেন, ‘অনেকের হয়তো অ্যান্টিবায়োটিক দরকার হয় না। নিজে নিজে নিয়ম না মেনে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া হলে শরীরে সেটার প্রতিরোধী ব্যবস্থা তৈরি হয়। পরবর্তীতে চিকিৎসক এ ধরনের ওষুধ দিলেও সেটা আর কাজ করে না।’
এছাড়া জ্বর তিনদিনের বেশি থাকলে অথবা জ্বরের সঙ্গে সঙ্গে অন্য কোনো উপসর্গ থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত। অনেক সময় টিবি বা লিম্ফোমার জন্য শুধুমাত্র রাতের বেলায় জ্বর আসতে পারে। এরকম দেখা দিলে অবশ্যই দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। চিকিৎসকরা সাধারণত সিবিসি, টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া, প্রস্রাব, ডেঙ্গু ইত্যাদি পরীক্ষা করে জ্বরের কারণ নির্ধারণের চেষ্টা করেন। তবে ক্যান্সার বা টিউমারের আশঙ্কা থাকলে এক্সরে বা সিটি স্ক্যানের মতো পরীক্ষাও করা হয়।
তাপমাত্রা স্বাভাবিক কিন্তু জ্বর জ্বর ভাব কেন হয়?
ডা. তৌফিক আহমেদ বলেন, আমাদের কাছে অনেক সময় রোগীরা এসে বলেন, তাদের জ্বর জ্বর ভাব লাগছে। কিন্তু থার্মোমিটারে মাপলে জ্বর আসে না। ‘এ ধরনের রোগকে আমরা ফিভারিশ ফিলিং বলি। রক্তশূন্যতার কারণে এরকম হতে পারে। উদ্বেগ বা অতিরিক্ত চিন্তার কারণে সেটা হতে পারে। আবার অনেক সময় শুধুমাত্র মানসিক কারণেও হয়ে থাকে।
জ্বর হলে মাথায় পানি দেয়া বা গোছল করা
ডা. তৌফিক আহমেদ এ বিষয়ে বলেন, শুধু মাথায় পানি দিলে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে আসবে না। ‘আমরা যেটা বলি, জ্বর হলে সারা শরীর সাধারণ ভেজা কাপড় দিয়ে মুছিয়ে দিতে। কারণ সারা শরীরের মধ্যে মাথা খুব ছোট একটি অংশ। ফলে শুধু মাথায় পানি দিলে উপকার পাওয়া যাবে না। সবচেয়ে ভালো হবে, শরীরের সব জায়গা স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানিতে ভেজা কাপড় দিয়ে মুছিয়ে দেয়া।
সংক্রমণের ঝুঁকি না থাকলে গোছল করলে কোন ক্ষতি হয় না বলেও তিনি জানান। বরং অনেক সময় উচ্চ তাপমাত্রা থাকলে রোগীদের গোছল করার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা।
জ্বরের জন্য কিছু পরামর্শ
যে কারণেই জ্বর আসুক না কেন, চিকিৎসকের শরণাপন্ন না হওয়া পর্যন্ত নিজেকে নিরাপদ রাখতে পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা।
ঘুম বা বিশ্রামে থাকা
জ্বর হলে শরীরের ভেতরে থাকা জীবাণুর বিরুদ্ধে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা লড়াই করতে শুরু করে। এসময় শরীরকে পরিপূর্ণ বিশ্রাম দেয়া উচিত।
প্রচুর তরল পানীয় পান করা
প্রচুর পরিমাণে তরল পানি বা ফলের রস পানের মাধ্যমে শরীরের পানিশূন্যতা রোধ করা যায়। বিশেষ করে লেবুর পানি ও গরম পানি পান করা যেতে পারে।
পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ
জ্বরের সময় অরুচি ভাব তৈরি হলেও ফলমূল বা পুষ্টিকর খাবার খাওয়া উচিত। তাহলে শরীর রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার মতো শক্তি সরবরাহ পায়।
উষ্ণ পরিবেশে থাকা
জ্বরের সময় শুষ্ক ও উষ্ণ পরিবেশে থাকতে হবে। এই সময় পরিষ্কার ও উষ্ণ পোশাক পরা উচিত। বিশেষ করে প্রসূতি বা অস্ত্রোপচারের পর অবশ্যই পরিষ্কার ও উষ্ণ কক্ষে থাকা উচিত।