নিরাপত্তা খাতের সংস্কারে র্যাব বিলুপ্তি বিবেচনা করতে হবে
নিজস্ব প্রতিবেদক
০৯ জুলাই, ২০২৫, 11:43 AM

নিজস্ব প্রতিবেদক
০৯ জুলাই, ২০২৫, 11:43 AM

নিরাপত্তা খাতের সংস্কারে র্যাব বিলুপ্তি বিবেচনা করতে হবে
ডব্লিউজিইআইডির সুপারিশ
বিচার প্রক্রিয়ার ওপর আস্থা কম গুমের শিকারদের
নিরাপত্তা খাত সংস্কারের অংশ হিসেবে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে (র্যাব) বিলুপ্তির কথা বাংলাদেশ সরকারকে অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে। এ বাহিনীর যেসব সদস্য জোরপূর্বক গুমের সঙ্গে জড়িত নন, তাদের নিজ নিজ বাহিনীতে ফেরত যাওয়ার বিষয়ও নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরকে (ডিজিএফআই) কেবল সামরিক গোয়েন্দা কার্যক্রমের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। সংস্থাটির আইনি কর্তৃত্ব ও সম্পদ স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত এবং সীমিত করতে হবে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের জোরপূর্বক গুম নিয়ে ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্স অর ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপিয়ারেন্সেসের (ডব্লিউজিইআইডি) এক প্রতিবদনে এ সুপারিশ করা হয়েছে।
গত জুনের মাঝামাঝি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফর করে ডব্লিউজিইআইডির দুই সদস্যের এক কারিগরি প্রতিনিধি দল। সফরকালে প্রতিনিধি দলটি প্রধান উপদেষ্টা, সেনাবাহিনী প্রধান, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা, আইন উপদেষ্টা, পুলিশ কর্মকর্তা, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) কৌঁসুলি, বাংলাদেশের গুম কমিশন এবং গুমের শিকার ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করে। ফিরে গিয়ে তারা বাংলাদেশে জোরপূর্বক গুম বিষয়ে বিদ্যমান উদ্বেগ এবং এ ক্ষেত্রে করণীয় বা সুপারিশসহ একটি প্রতিবেদন দেয়। গত ২৫ জুন ডব্লিউজিইআইডি তা সরকারকে পাঠায়।
এর আগে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে র্যাব বিলুপ্ত করতে সুপারিশ করেছিল অন্তর্বর্তী সরকারের তৈরি গুম কমিশন, জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের তথ্যানুসন্ধান দল এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।
ডব্লিউজিইআইডি প্রতিবেদনে বলছে, বাংলাদেশে বেশির ভাগ জোরপূর্বক গুম সংঘটিত হয়েছে র্যাবের হাতে। পাশাপাশি ডিজিএফআইও এর সঙ্গে বিভিন্ন সময় সম্পৃক্ত হয়েছে। র্যাব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন পুলিশের একটি বিশেষ ইউনিট। আর ডিজিএফআই প্রধানমন্ত্রীর অধীন গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা করে। এই ইউনিটগুলো গঠিত হয়েছে সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যদের নিয়ে।
জোরপূর্বক গুম বিষয়ে অব্যাহত দায়মুক্তি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ডব্লিউজিইআইডি। তারা বলেছে, সেনাবাহিনী, ডিজিএফআই, র্যাবসহ সব নিরাপত্তা বাহিনীর সংশ্লিষ্টদের উচিত চলমান তদন্ত ব্যবস্থাকে পূর্ণ সহযোগিতা করে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে প্রকৃত অর্থে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়া। এর মাধ্যমেই কেবল সংস্থাগুলোর প্রতি ভুক্তভোগী এবং জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার সম্ভব।
প্রতিবেদনে ডব্লিউজিইআইডি বলেছে, জোরপূর্বক গুমের শিকার অনেকে বলেছেন, বিচার প্রক্রিয়ার ওপর তাদের খুব কমই আস্থা আছে। কারণ, গুমের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযুক্ত বেশির ভাগ এখনও নিজ অবস্থানে আছেন। দায়মুক্তির সংস্কৃতির পুনরাবৃত্তি রোধের পথে এটি স্পষ্ট বাধা। রাষ্ট্রের উচিত সামগ্রিক যাচাই-বাছাই করে গুমের সঙ্গে জড়িতদের নিরাপত্তা বাহিনী এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে অপসারণ করা।
এই প্রতিবেদনের সুপারিশের বিষয়ে জানালে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার এম জেড এম ইন্তেখাব চৌধুরী সমকালকে বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর বাহিনীর ভেতর ইতোমধ্যে সংস্কার কার্যক্রম চলছে। তিনি বলেন, র্যাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সরকারি আদেশে। ফলে সরকার আবার আদেশ দিলে র্যাবে থাকা সেনা, নৌ, বিমান, বর্ডার গার্ড, পুলিশ, কোস্টগার্ড ও আনসার সদস্যরা তাদের নিজ বাহিনীতে ফেরত যাবে। সরকার যেভাবে আদেশ দেয়, র্যাব সেভাবে কাজ করে।
র্যাবের অসংখ্য ভালো কাজ রয়েছে জানিয়ে ইন্তেখাব চৌধুরী বলেন, এ বাহিনী থাকাটা প্রয়োজন। তবে আগের যে কালো অধ্যায়গুলো ছিল, তার যাতে পুনরাবৃত্তি না হয়– সে জন্য কঠোরভাবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতের ব্যবস্থা করা যায়। প্রয়োজনে এই বাহিনীর কার্যপরিধির সংস্কার করে কী করা যাবে, কতটুকু করা যাবে এবং কী করা যাবে না– তা নির্ধারণ করে দেওয়া যায়।
র্যাব বিলুপ্তি নিয়ে মতানৈক্যে পশ্চিমা দেশগুলো
জুলাই-পরবর্তী বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রয়োজনীয় সংস্কার নিয়ে ‘আফ্টার দ্য মনসুন রেভল্যুশন: এ রোডম্যাপ টু লাস্টিং সিকিউরিটি সেক্টর রিফর্ম ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে এইচআরডব্লিউ। গত জানুয়ারিতে দেওয়া প্রতিবেদনটি পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনীতিকদের কাছেও তুলে ধরেছে সংস্থাটি।
র্যাবের বিলুপ্তি নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে প্রতিবেদন প্রকাশের সময় বেশ কিছু প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। বিশেষ করে ইউরোপের কয়েকটি দেশের কূটনীতিকদের মধ্যে র্যাব বিলুপ্তির সুপারিশ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। বিষয়টি সমকালকে নিশ্চিত করেছেন প্রতিবেদন প্রকাশে আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা একাধিক কূটনীতিক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পশ্চিমা দেশের এক রাষ্ট্রদূত সমকালকে বলেন, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই– র্যাব গঠনের পর থেকে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে। আর এ বাহিনীর গঠন, প্রশিক্ষণ এবং সরঞ্জামের সহযোগিতা এসেছে পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে। মূলত সে সময়টিতে বিশ্বজুড়ে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। তারই প্রেক্ষাপটে পশ্চিমারা এ বাহিনীকে সহযোগিতা করে। তবে বাহিনীটি জঘন্য অপরাধ দমনের পাশাপাশি ভাড়াটে হিসেবেও কাজ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
ওই কূটনীতিক বলেন, এটি সত্য– র্যাব যেমন জঘন্য অপরাধ দমন করেছে, তেমনি নিজেরাও গুরুতর অপরাধ করেছে। এখন র্যাবকে যদি বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়, তবে অপরাধ দমন কার্যক্রমে বড় ধাক্কা খাবে বাংলাদেশ। এমনিতেই জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। পরিস্থিতির ওপর সরকারের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ রয়েছে– বলা যাবে না। এ অবস্থায় র্যাবের বিলুপ্তি জনগণের নিরাপত্তাবোধ কমিয়ে দেবে। অন্যদিকে দাগি অপরাধীরা একটি ভিন্ন বার্তা পাবে। বরং বাহিনীটির প্রয়োজনীয় সংস্কারে মনোযোগ দেওয়া উচিত।
এইচআরডব্লিউ ব্রিফিংয়ে উপস্থিত থাকা পশ্চিমা আরেক কূটনীতিক বলেন, শেখ হাসিনার আমলে নিরাপত্তা বাহিনীগুলো যেভাবে রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে, সেখান থেকে বের হয়ে তাদের সংস্কার করা কঠিন হবে। এটি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। র্যাবকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে জবাবদিহি নিশ্চিত এবং নির্যাতনমূলক অভ্যাস বন্ধ করা কোনো সহজ কাজ নয়। ৫ আগস্টের পরেও বাহিনীটির অপরাধ লুকানোর প্রবণতা দেখা গেছে। বিশেষ করে এই বাহিনী তাদের ‘আয়নাঘর’গুলো ধ্বংস করে দিয়ে অপরাধের আলামত নষ্ট করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এই কূটনীতিক মনে করেন, এ অবস্থায় রাজনৈতিক সরকার ফেরত এলে বাহিনীটি যে তাদের আগের রূপে ফেরত আসবে না– তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ যে দলই ক্ষমতায় এসেছে, তারা র্যাবকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে।