ঢাকা ০৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
সংবাদ শিরোনাম
মহাসড়কের বিভাজনে বসবাস করা অসুস্থ বৃদ্ধের ঠাঁই হলো হাসপাতালে সিলেটে প্রাইভেটকার-ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ৪ আবারও বাড়ল এলপি গ্যাসের দাম গণঅভ্যুত্থানে আহতদের অবস্থানে স্থবির মিরপুর সড়ক ৬ খাল সংস্কার কার্যক্রম উদ্বোধন করলেন ৩ উপদেষ্টা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ছিনতাই ও ডাকাতির বন্ধে চালকদের মানববন্ধন সড়কে আলু ফেলে চাষিদের বিক্ষোভ আ. লীগের লিফলেট বিতরণ করা আমার অধিকার, বললেন সেই বিসিএস কর্মকর্তা তোফাজ্জল হত্যা: পুলিশের অভিযোগপত্রে নারাজি ঢাবি প্রশাসনের যুক্তরাষ্ট্রে ফের বিধ্বস্ত বিমান, বেঁচে নেই কোনো আরোহী

আর্থিক লেনদেন ও মুমিনের দায়িত্ব

#

নিজস্ব প্রতিবেদক

০১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫,  10:39 AM

news image

হিসাববিজ্ঞানের ভাষায়, আর্থিক লেনদেন বলতে এমন একটি ব্যাবসায়িক ঘটনাকে বোঝায়, যেটিকে অবশ্যই অর্থের মাপকাঠিতে পরিমাপ করা সম্ভব। এই লেনদেন কর্মকাণ্ড ব্যবসা বা কারবারের কর্মকাণ্ড ও আর্থিক অবস্থার ওপর প্রভাব ফেলে। মূলত অর্থের সঙ্গে সম্পর্ক আছে—এমন লেনদেনকেই আর্থিক লেনদেন বলা হয়। 

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আর্থিক লেনদেন একটি অপরিহার্য বিষয়।

সারা দিন আমরা কোনো না কোনোভাবে আর্থিক লেনদেনের সঙ্গে জড়িত আছি। জীবন পরিচালনার জন্য নানা জিনিস ও পণ্য আমাদের সংগ্রহ করতে হয় অথবা কোনো না কোনো সেবা আমাদের গ্রহণ করতে হয়। আর এসবের সঙ্গে অর্থের সম্পর্ক রয়েছে। অর্থের বিনিময়ে আমরা কোনো না কোনো জিনিস ক্রয় করি।

যেমন—খাবারদাবার, পোশাক, ওষুধ ইত্যাদি। আবার অনেক সময় নানা রকম সেবাও গ্রহণ করি। যেমন ঘরের লাইট নষ্ট হয়েছে বা পানির কল খারাপ হয়েছে তা ঠিক করার জন্য মিস্ত্রির সহায়তা নেই। তাকে পারিশ্রমিক দিই।

এখানে সেবার বিনিময়ে অর্থের লেনদেন হয়। আর এসবই আর্থিক লেনদেনের অন্তর্ভুক্ত।

আর্থিক লেনদেন ও মুমিনের পরিচয় : সামাজিক জীব হিসেবে আমাদের একে অন্যের সাহায্য-সহযোগিতা নিয়েই বেঁচে থাকতে হয়। ফলে মানুষের সঙ্গে আমাদের প্রায়ই অনেক ধরনের আর্থিক লেনদেন হয়ে থাকে। সাধারণভাবে এই লেনদেনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, আমানতদারিতা ও সততা হলো অন্যতম একটি মাপকাঠি।

যার লেনদেন স্বচ্ছ তিনিই সমাজে সৎ ও সততার অধিকারী। ইসলামেও লেনদেনকে ধার্মিকতা মাপকাঠি ধরা হয়েছে। একজন মুমিনকে অবশ্যই লেনদেনে সৎ ও স্বচ্ছ থাকতে হবে। সময়মতো লেনদেন সম্পন্ন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ওয়াদা ঠিক রাখতে হবে। একজন মুমিনের সত্যবাদিতার পরিচয় হচ্ছে তার লেনদেন। একবার এক ব্যক্তি উমর (রা)-এর কাছে একজনের প্রশংসা করে বলল, ‘ওই ব্যক্তি খুব সত্যবাদী।’ তখন উমর (রা.) বললেন, ‘আচ্ছা তুমি কী তার সঙ্গে সফর করেছ? লোকটি জবাবে না বলল। উমর (রা.) আবার বললেন, তুমি কী তার সঙ্গে কোনো লেনদেন করেছ? এবারও লোকটি বলল,  না। এরপর উমর (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কী তার কাছে কোনো আমানত রেখেছ? সে এবারও বলল, না।’ তখন উমর (রা.) বললেন, ‘তাহলে ওই লোকটির ব্যাপারে তোমার কোনো ধারণা নেই। মনে হয়, তুমি তাকে মসজিদে রুকু-সিজদা করতে দেখেছ অর্থাৎ শুধু মসজিদের গণ্ডিতে দেখেই যে তাকে ধার্মিক ও সত্যবাদী মনে করেছ এবং তার গুণের প্রশংসা করেছ, এটা ঠিক নয়। প্রকৃত পরিচয় তো জানবে লেনদেনের পর।’ (কানজুল উম্মাল, হাদিস : ২৫৫৭০)

আমরা জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে লেনদেন বা মুয়ামালাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। লেনদেনের মাধ্যমে জীবন যাপন করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। আর লেনদেন ছাড়া কারো পক্ষে সঠিকভাবে ইবাদত-বন্দেগি করাও অসম্ভব। দ্বিনের ইবাদত-বন্দেগি আমাদের জন্য সীমিত। কিন্তু মুয়ামালাত বা লেনদেনের পরিধি বা সীমা ব্যাপক বিস্তৃত। তাই ইসলামে মুয়ামালাত বা লেনদেনের গুরুত্ব অনেক বেশি। আমরা যেসব ইবাদত করি বা অধিকার বা দায়দায়িত্ব বিষয়ের মোকাবেলা করি, তা দুই ধরনের। এক. আল্লাহর হক, দুই. বান্দার হক। আল্লাহর হক সঠিকভাবে পালনে ব্যর্থ হলে তাঁর কাছে মার্জনা চেয়ে ক্ষমা পেতে পারি। কিন্তু বান্দার  হক বা বান্দার সঙ্গে লেনদেনে ব্যর্থ হলে এই ত্রুটি বা গুনাহ আল্লাহ মাফ করবেন না। তাই বান্দার হক সঠিকভাবে আদায় করা বা লেনদেন ও কায়কারবারে স্বচ্ছ থাকার ব্যাপারে আল্লাহর রাসুল (সা.) সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার কোনো ভাইয়ের সম্মানহানির মাধ্যমে বা অন্য কোনো প্রকারে তার ওপর জুলুম করেছে, সে যেন আজই তার সঙ্গে লেনাদেনা সাফ করে নেয়। ওই দিন আসার পূর্বেই, যেদিন তার কাছে কোনো দিনার-দিরহাম (মানে টাকা-পয়সা) থাকবে না। সেদিন যদি তার কাছে কোনো নেক আমল থাকে তবে তার জুলুম পরিমাণ সেখান থেকে নিয়ে নেওয়া হবে এবং পাওনাদারকে আদায় করে দেওয়া হবে।  আর যদি কোনো নেক আমল না থাকে তাহলে যার ওপর জুলুম করা হয়েছে তার পাপের বোঝা জুলুম অনুযায়ী তার ঘাড়ে চাপানো হবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৪৪৯)

আর্থিক লেনদেনে মুমিনের দায়িত্ব : আর্থিক লেনদেনের বেলায় একজন মুমিনের দায়িত্ব হচ্ছে সে সময়মতো আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করবে। লেনদেনের সময় ঠিক রাখবে, মানে ওয়াদা রক্ষা করবে, ব্যবসায় করলে ওজনে কম দেবে না, বিক্রির সময় মিথ্যা শপথ কাটবে না, পণ্যের সঠিক গুণ প্রকাশ করবে, প্রতারণা ও ধোঁকাবাজি করবে না, মজুদদারি করবে না ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে সততা, স্বচ্ছতা ও আমানতদারিতা রক্ষা করে চলবে। যে ব্যবসায়ী ওজনে কম দেয় তার সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘দুর্ভোগ তাদের জন্য যারা ওজনে কম দেয়।’

(সুরা : মুতাফফিফিন, আয়াত : ১)

যারা অন্যায়ভাবে বা প্রতারণামূলকভাবে মানুষের সম্পদ গ্রাস করে তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করবে না।’

(সুরা : নিসা, আয়াত : ২৯)

লেনদেন সঠিকভাবে না হলে বা তাতে অস্বচ্ছতা থাকলে মানুষের ইবাদতও কবুল হয় না। আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ইবাদত-বন্দেগি করি, নামাজ পড়ি, রোজা রাখি এবং অন্যান্য ভালো আমল করি। তবে যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে বা অবৈধ পথে সম্পদ উপার্জন করে বা অস্বচ্ছ আর্থিক লেনদেন করে, আল্লাহ তার ইবাদত-বন্দেগি ও দোয়া কবুল করেন না। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, ‘হে আমার রব, হে আমার রব! অথচ তার খাদ্য-পানীয় হারাম, পোশাক-পরিচ্ছদ হারাম, তাহলে কিভাবে তার দোয়া কবুল হবে?’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৯৮৯)

আর্থিক লেনদেন বা ঋণ পরিশোধে গড়িমসি করার

পরিণাম : আর্থিক লেনদেন বা ঋণের বেলায় আমাদের অনেকে ঋণ না দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ করি। অনেক সময় তা পরিশোধে গড়িমসি করতে দেখা যায়। অনেকের মধ্যে আর্থিক সংগতি থাকা সত্ত্বেও তার মধ্যে গড়িমসি বা টালবাহানার দোষ পরিলক্ষিত হয়। এই গড়িমসি বা টালবাহানা সম্পর্কে ইসলাম সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘সচ্ছল ব্যক্তির ঋণ পরিশোধে টালবাহানা বা গড়িমসি করা অন্যায় বা জুলুম।’

(সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৪০০)

তিনি অন্যত্র বলেন, ‘যে সচ্ছল ব্যক্তি ঋণ পরিশোধে গড়িমসি করে, তাকে অপমান ও শাস্তি উভয়টিই দেওয়া আমার কাছে হালাল।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৬২৮)

মহানবী (সা.) আরো বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি তার হাত দিয়ে যা গ্রহণ করেছে, তা পরিশোধ না করা পর্যন্ত সে দায়ী থাকবে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১২৬৬)

সঠিক সময়ে ঋণ পরিশোধের বিষয়টি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে তার বিলম্বে ঋণগ্রহীতা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং কিয়ামতের দিন সে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, ‘ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির আত্মা লটকে থাকে, যতক্ষণ না তার পক্ষ থেকে কেউ সেই ঋণ পরিশোধ করে দেয়।’

(ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৪১৩)

রাসুল (সা.) অন্যত্র বলেন, ‘যে ব্যক্তি একটি দিনার অথবা দিরহাম ঋণ রেখে মারা যাবে, কিয়ামতের দিন তাকে তার নেকি থেকে সেই ঋণ পরিশোধ করতে হবে। কারণ সেখানে কোনো দিনার বা দিরহাম নেই।’

(ইবসে মাজাহ, হাদিস : ৫৫১৯)

শহীদের বেলায়ও ঋণের ব্যাপারে কোনো মাফ নেই। যেখানে বলা হয়েছে শহীদের সব গুনাহ মাফ করা হবে এবং তারা বিনা বিচারে জান্নাত লাভ করবেন। তার পরও শুধু ঋণের বিষয়টির মাফ নেই। তাই রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ঋণ পরিশোধের পাপ ছাড়া শহীদদের সব পাপ মাফ করে দেওয়া হবে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৯১২)

ঋণের অর্থ পরিশোধ করার সময় খুশি হয়ে বেশি ফেরত দেওয়ার বিধানও ইসলামে রয়েছে। সাহাবি জাবের (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) আমার কাছ থেকে কিছু ঋণ নিয়েছিলেন। পরে যখন তা আমাকে ফেরত দেন, তখন আমার পাওনার চেয়েও বাড়িয়ে দিলেন।’

(আবু দাউদ, হাদিস : ৩৩৪৯)

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে লেনদেনের গুরুত্ব এবং তার সঠিক বিধান সম্পর্কে অবহিত হওয়ার তৌফিক দান করুন।

logo

সম্পাদক ও প্রকাশক : মো. নজরুল ইসলাম