হাসপাতালে দিনে গড়ে ভর্তি ২৬৯ টাইফয়েড রোগী
১৯ নভেম্বর, ২০২৫, 12:36 PM
NL24 News
১৯ নভেম্বর, ২০২৫, 12:36 PM
হাসপাতালে দিনে গড়ে ভর্তি ২৬৯ টাইফয়েড রোগী
টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে গত বছর সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৯৮ হাজারে ২৪৩ রোগী। সেই হিসাবে দৈনিক গড়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ২৬৯ জন। মারা গেছেন ৮১ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২০২৪ সালের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। বিশ্লেষকদের ধারণা, টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়েও অনেকে হাসপাতালে ভর্তি হন না। সেই হিসাব ধরলে প্রকৃত আক্রান্ত ও মৃত্যু সংখ্যা সাত থেকে আট গুণ হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল বার্ডেন অব ডিজিজ (জিবিডি) তাদের ২০২১ সালের প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশে বছরে আনুমানিক চার লাখ ৭৮ হাজার মানুষ টাইফয়েডে আক্রান্ত হন, প্রায় আট হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। মৃতের ৬৮ শতাংশই শিশু। সংক্রমণ কমাতে ৯৫ শতাংশ টিকাদান কভারেজ অর্জনই ছিল সাম্প্রতিক বিশেষ টিকা কর্মসূচির লক্ষ্য।
ঢাকার কয়েকটি সরকারি হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, শিশু, কিশোর, প্রাপ্তবয়স্ক– সব বয়সীর ক্ষেত্রে টাইফয়েডে আক্রান্তের হার বাড়ছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে বর্তমানে ২০ জন এই রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন। হাসপাতালটির জরুরি বিভাগে কর্মরত সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, কয়েক সপ্তাহে টাইফয়েড-সংশ্লিষ্ট জ্বর, ডায়রিয়া ও পানিশূন্যতা নিয়ে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ধারাবাহিক বাড়ছে। বর্ষার পরে পানিবাহিত রোগ বাড়ে, তবে এ বছর তা কিছুটা বেশি। অনেক রোগী দেরিতে আসছেন, ফলে জটিলতা বাড়ছে।
চিকিৎসকরা জানান, দীর্ঘস্থায়ী জ্বর, মাথাব্যথা, পেটব্যথা, ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য– এ ধরনের উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসা না নিলে টাইফয়েড মারাত্মক জটিলতার দিকে যেতে পারে। দূষিত পানি, অস্বাস্থ্যকর খাবার, স্যানিটেশনের অভাবে এই রোগ দেখা দিতে পারে।
জ্যেষ্ঠ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, টাইফয়েড প্রতিরোধে নিরাপদ পানি নিশ্চিত করা, খাদ্য প্রস্তুত ও পরিবেশনের সময় পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা এবং জনসচেতনতা বাড়ানো জরুরি। দূষিত পানি, রাস্তার খাবারের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং সঠিক স্যানিটেশন ব্যবস্থার ঘাটতি টাইফয়েড বাড়ার মূল কারণ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাংলাদেশ প্রতিনিধি ড. আহমেদ জমশিদ মোহাম্মদ বলেন, টাইফয়েড এখনও বৈশ্বিকভাবে হুমকির, প্রতি বছর ৯ মিলিয়ন আক্রান্ত এবং এক লাখ ১০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। বাংলাদেশে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী টাইফয়েড বাড়ায় ঝুঁকি আরও বেশি। ঢাকার বিভিন্ন গবেষণায়ও দেখা গেছে, টাইফয়েডের ব্যাকটেরিয়া ক্রমেই অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি অসহনশীল হয়ে উঠছে।
২০২০ সালের ২৮ জানুয়ারি ঢাকায় ডায়রিয়াজনিত রোগ ও পুষ্টিবিষয়ক পঞ্চদশ এশীয় সম্মেলনেও (অ্যাসকড) টাইফয়েড টিকার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়। ওষুধ প্রতিরোধী রোগ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করা যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গর্ডন ডোগান সম্মেলনে জানান, ঢাকা নগরে টাইফয়েডের জীবাণু ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে।
অন্যদিকে ঢাকার শিশু স্বাস্থ্য গবেষণা ফাউন্ডেশনের প্রধান অধ্যাপক সমীর সাহা জানান, অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হওয়ার সমাধান পাওয়া যেতে পারে টাইফয়েড টিকার ব্যবহারের মাধ্যমে। ওই সম্মেলনেই জানানো হয়েছিল, সরকার খুব শিগগির দেশে কলেরা, টাইফয়েড, এইচপিভি ও রোটাভাইরাসের টিকার ব্যবহার শুরু করবে।
আইসিডিডিআরবির নির্বাহী পরিচালক তাহমিদ আহমেদ বলেন, অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে মৃত্যু কমানো গেলেও এখন ওষুধই অকার্যকর হয়ে পড়ছে। তাই টিকানির্ভর প্রতিরোধই সবচেয়ে কার্যকর পথ।
সাড়ে তিন কোটি শিশুকে টিকা
সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) তথ্য অনুযায়ী, টাইফয়েড প্রতিরোধে দেশজুড়ে বিশেষ টিকাদান কর্মসূচি করা হয়েছে। ১২ অক্টোবর থেকে ৯ নভেম্বর পর্যন্ত ৯ মাস থেকে ১৫ বছর বয়সী প্রায় সাড়ে তিন কোটি শিশু টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন (টিসিভি) পেয়েছে, যা মোট লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৭০ শতাংশ।
ইপিআইর উপপরিচালক মো. শাহারিয়ার সাজ্জাদ বলেন, টাইফয়েড টিকাদানের বিশেষ ক্যাম্পেইন শেষ হয়েছে। এ বছর আর ক্যাম্পেইন হবে না। অ্যান্টিবায়োটিক আগের মতো কার্যকর নয়, তাই বড় পরিসরে টিকাদান গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ২০২৬ সাল থেকে টিসিভি নিয়মিত জাতীয় টিকাদান সূচিতে যুক্ত হবে। বাংলাদেশ টাইফয়েড প্রতিরোধী এই টিকাটি পেয়েছে আন্তর্জাতিক ভ্যাকসিন সহায়তা সংস্থা গ্যাভির মাধ্যমে। এক ডোজের ইনজেকটেবল এই টিকা তিন বছর পর্যন্ত টাইফয়েড থেকে শিশুদের সুরক্ষা দেবে। ২০২০ সাল থেকেই এই টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মাধ্যমে যাচাই করা, এটি নিরাপদ ও কার্যকর হিসেবে প্রমাণিত। সব মিলিয়ে আট দেশে শিশুদের এই টিকা দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও নেপালে শিশুদের টাইফয়েডে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি। তাই এসব অঞ্চলে বড় পরিসরে টিকাদান কর্মসূচি করা হয়েছে। সূত্র : দৈনিক সমকাল