বিয়ের প্রথম বছরেই ‘ইচ্ছার বাইরে’ গর্ভবতী ৭৩ শতাংশ নারী
নিজস্ব প্রতিবেদক
১৭ ডিসেম্বর, ২০২৫, 4:17 PM
নিজস্ব প্রতিবেদক
১৭ ডিসেম্বর, ২০২৫, 4:17 PM
বিয়ের প্রথম বছরেই ‘ইচ্ছার বাইরে’ গর্ভবতী ৭৩ শতাংশ নারী
আইসিডিডিআর-বি
বিয়ের মাধ্যমে নতুন জীবনের শুরু হলেও বাংলাদেশের হাজারো নারীর জন্য সেই জীবন শুরু হচ্ছে নিয়ন্ত্রণ, চাপ আর সিদ্ধান্তহীনতার মধ্য দিয়ে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর-বি) এক দীর্ঘমেয়াদী গবেষণায় দেখা গেছে, বিয়ের মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই পাঁচজনের মধ্যে চারজন নারী স্বামীর নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণের শিকার হচ্ছেন।
একই সঙ্গে বিয়ের প্রথম বছরের মধ্যেই ৭৩ শতাংশ নারী গর্ভবতী হয়ে পড়ছেন– যার বড় অংশই ছিল, তাদের ইচ্ছার বাইরে বা সময়ের আগেই। বুধবার (১৭ ডিসেম্বর) ঢাকায় আইসিডিডিআরবির সাসাকাওয়া অডিটোরিয়ামে ‘বাংলাদেশের নির্বাচিত গ্রামীণ ও শহরাঞ্চল নববিবাহিত দম্পতিদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার সংক্রান্ত প্রেক্ষাপট ও চাহিদা নিরূপণ’ শীর্ষক এই গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডার অর্থায়নে পরিচালিত দুই বছরব্যাপী এই গবেষণাটি বাংলাদেশে নববিবাহিত দম্পতিদের বিয়ের পরবর্তী জীবন নিয়ে প্রথম দীর্ঘমেয়াদী নিবিড় গবেষণা।
গবেষণায় দেখা গেছে, দাম্পত্য জীবনের শুরুতেই নারীদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় বড় ধরনের হস্তক্ষেপ শুরু হয়। বিয়ের প্রথম ছয় মাসের মধ্যেই ৭৯ শতাংশ নারী স্বামীর নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। এই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলাফেরা, পড়াশোনা, কর্মসংস্থান, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ এবং সন্তান নেওয়ার সিদ্ধান্ত পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত। গবেষকরা বলছেন, এই নিয়ন্ত্রণই ধীরে ধীরে সহিংসতার পথে নিয়ে যায়। দুই বছরের মধ্যে ৫২ শতাংশ নারী আর্থিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। পাশাপাশি ২৩ শতাংশ নারী মানসিক, ১৫ শতাংশ শারীরিক এবং ১৪ শতাংশ যৌন সহিংসতার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। মাত্র ৪ শতাংশ নারী জানান, তারা এই সময়ের মধ্যে কোনো ধরনের সহিংসতার মুখে পড়েননি।
ইচ্ছার বাইরে মাতৃত্বের চাপ
গবেষণার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উঠে এসেছে দ্রুত ও অনিচ্ছাকৃত গর্ভধারণের চিত্রে। মোট অংশগ্রহণকারী নারীদের মধ্যে ৭৩ শতাংশ বিয়ের প্রথম বছরের মধ্যেই গর্ভবতী হয়েছেন। এর মধ্যে প্রায় ৪৭ শতাংশ গর্ভধারণ ছিল অনিচ্ছাকৃত বা সময়ের আগেই।
বিশেষ করে শহরের বস্তি এলাকায় বসবাসকারী নারীদের মধ্যে এই সমস্যা আরও প্রকট। সেখানে ৬৮ শতাংশ নারী অন্তত দুই বছর সন্তান নেওয়া পিছিয়ে দিতে চাইলেও বাস্তবে ৬৭ শতাংশ নারী সেই সময়ের মধ্যেই গর্ভবতী হয়ে পড়েন। গবেষকদের মতে, গর্ভনিরোধক ব্যবহারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে নারীর সীমিত ক্ষমতাই এর প্রধান কারণ।
শিক্ষা ও কর্মজীবন থেমে যাওয়ার বাস্তবতা
গবেষণায় দেখা গেছে, বিয়ের পরপরই নারীদের শিক্ষা ও কর্মজীবন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গ্রামে ৬০ শতাংশ এবং শহরের বস্তিতে ৬৬ শতাংশ নারী বিয়ের পর পড়াশোনা বন্ধ করেছেন। স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির আপত্তি, পারিবারিক সিদ্ধান্ত, বাসস্থান পরিবর্তন, সামাজিক রীতি এবং আর্থিক সীমাবদ্ধতাকে এর প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
আয়মূলক কাজের ক্ষেত্রেও একই ধরনের নিয়ন্ত্রণ দেখা গেছে। অনেক নারী কাজ করতে আগ্রহী হলেও স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির বাধার কারণে সেই সুযোগ পাননি। গবেষকদের মতে, এই অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতাই পরবর্তীতে নারীদের সহিংসতার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
বাল্যবিবাহ এখনো বড় চ্যালেঞ্জ
গবেষণায় অংশ নেওয়া নারীদের মধ্যে গ্রামে ৪৩ শতাংশ এবং শহরের বস্তিতে ৬৫ শতাংশের বিয়ে হয়েছে ১৮ বছরের আগেই। পুরুষদের মধ্যেও কম বয়সে বিয়ের হার উল্লেখযোগ্য– গ্রামে ১৫ শতাংশ এবং শহরে ৩৭ শতাংশ পুরুষ ২১ বছরের আগেই বিয়ে করেছেন।
কম বয়সে বিয়ে করা নারীদের বড় একটি অংশের বিয়ে পরিবার থেকেই ঠিক করা হয়েছিল। গ্রামে এই হার ৮৫ শতাংশ এবং শহরে ৫৩ শতাংশ। গবেষকরা বলছেন, বাল্যবিবাহ নারীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতাকে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
গবেষণার ক্ষেত্র ও পদ্ধতি
ডিসেম্বর ২০২২ থেকে ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত পরিচালিত এই মিশ্র-পদ্ধতির গবেষণায় আইসিডিডিআরবির চারটি হেলথ অ্যান্ড ডেমোগ্রাফিক সার্ভিলেন্স সিস্টেম এলাকায় তথ্য সংগ্রহ করা হয়। গ্রামাঞ্চলে কক্সবাজারের চকরিয়া ও চাঁদপুরের মতলব এবং শহরে ঢাকার মিরপুর ও কড়াইল বস্তি অন্তর্ভুক্ত ছিল। মোট ৬৬৬ নববিবাহিত দম্পতি এতে অংশ নেন। যাদের প্রথম বিয়ে, বিয়ের বয়স ছয় মাসের কম এবং বিয়ের আগে কোনো গর্ভধারণের ইতিহাস ছিল না—এমন দম্পতিদেরই গবেষণার জন্য নির্বাচন করা হয়। প্রতি চার মাস অন্তর দুই বছরে মোট ছয় দফা তথ্য সংগ্রহ করা হয়। অনুষ্ঠানে গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেন আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী ও প্রধান গবেষক ড. ফৌজিয়া আখতার হুদা,
সহকারী বিজ্ঞানী তারানা-ই-ফেরদৌস এবং রিসার্চ ইনভেস্টিগেটর সৈয়দ হাসান ইমতিয়াজ। সেমিনারে বক্তারা বলেন, দেশে এখনো বিপুল সংখ্যক বাল্যবিবাহ হচ্ছে, বিশেষ করে প্রান্তিক ও গ্রাম এলাকায়। বাল্যবিবাহ বন্ধ করা না গেলে নারীর শিক্ষা, প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার নিশ্চিত করা কঠিন হবে। তারা আরও বলেন, বিয়ের পরের প্রথম কয়েক বছরই নারীদের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সময়– এই সময়ে সুরক্ষা, সচেতনতা এবং স্বাস্থ্যসেবায় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ জোরদার না হলে সহিংসতা ও অনিচ্ছাকৃত মাতৃত্বের এই চক্র ভাঙা সম্ভব নয়।