ঢাকা ১৬ জুন, ২০২৫
সংবাদ শিরোনাম
নারায়ণগঞ্জে মাসুদুজ্জামানের ঈদপূণর্মিলন টক অব দ্যা টাউন একীভূত হচ্ছে বেসরকারি খাতের ৫ ব্যাংক অস্ত্র-মাদকসহ সাতক্ষীরায় সাবেক এমপির পুত্র আটক ভারতে হেলিকপ্টার বিধ্বস্তে সব আরোহী নিহত দেশে বাড়ছে ডেঙ্গু-করোনা, বাড়তি সতর্কতা এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র নিয়ে যে নির্দেশনা দিল শিক্ষা বোর্ড ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় রক্তাক্ত ইসরায়েল, শোকে মুষড়ে পড়েছেন প্রেসিডেন্ট দেশের ২৬ ভাগ ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বরগুনায় পুলিশ এখন আগের চেয়েও বেশি একটিভ: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা প্রেস ক্লাব এলাকায় পুলিশের সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ

দেশের ২৬ ভাগ ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বরগুনায়

#

নিজস্ব প্রতিনিধি

১৫ জুন, ২০২৫,  2:36 PM

news image

‘কোন হানে (কোন জায়গায়) পানি না থাকলেও মোগো (আমাদের) এলাকায় পানি থাহে (থাকে) সবসময়। সবাই ময়লা-আবর্জনা ডোবায় হালায় (ফেলে), পরিষ্কার করে না কেউ। মোগো ডেঙ্গু ওইবে (হবে) না, ওইবে কাদের।’ এমন অসহায়ত্বের কথা বলছিলেন বরগুনা সদর উপজেলার ২নং গৌরীচন্না ইউনিয়নে দক্ষিণ মনসাতলী গ্রামের ডেঙ্গু আক্রান্ত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জুলন চন্দ্র শীল। তার ১০ জনের পরিবারে ইতোমধ্যেই ৫ জন আক্রান্ত হয়েছেন ডেঙ্গু জ্বরে। যাদের মধ্যে রয়েছে ভাই মিলন চন্দ্র শীল, মেয়ে লাকী রাণী, ভাইয়ের মেয়ে বিন্দা ও ভাগিনা সৌরভ। ওই এলাকার শুধু জুলন চন্দ্র শীলের পরিবারেরই এমন অবস্থা নয়, প্রতিটি ঘরে ঘরে আক্রান্ত হচ্ছে ডেঙ্গু জ্বরে। সদর উপজেলার দক্ষিণ মনসাতলী গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে ৮টি ঘরের ডেঙ্গু সংক্রান্ত তথ্য নেয়া হয়। এতে দেখা যায় ওইসব পরিবারের ৩৯ জনের মধ্যে ২৬ জন ইতোমধ্যেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে ওই এলাকার ইউনুস শিকদারের ছেলে কামাল হোসেন, ইমরান টিটু, ছেলের বৌ কুলসুম আক্তার, নাতী ইয়ামিন ও ইয়াশা। মো. হেমায়েত উদ্দীন এর স্ত্রী মোসা. রাহিমা, ছেলে আব্দুল আলীম, পুত্রবধূ শারমিন এবং নাতী আফিয়ান। একই এলাকার সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন মো. নুর আলমের ৫ জনের পরিবারে ৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। যাদের মধ্যে স্ত্রী খাদিজা বেগম, মেয়ে ছালমা জাহান, পুত্রবধূ রিপা আক্তার ও নাতী নাবিল। এদের অধিকাংশ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরেছেন। তবে রিপা আক্তারকে বরগুনা জেনারেল হাসপাতাল থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বৃহস্পতিবার (১২ জুন) বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় বরগুনা জেলায় নতুন ডেঙ্গু আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছে ৫৪ জন। শনিবার (১৪ জুন) বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছে ২৪১ জন। গত ১ জানুয়ারী থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত বরগুনা জেলায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১ হাজার ৭৫৯ জন। চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছে ১ হাজার ৫১৮ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ৫ জনের। এদিকে, গত ১০ জুন বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের এলাকা ভিত্তিক একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে জেলায় প্রায় ১৩শ’ ডেঙ্গু আক্রান্তের মধ্যে ৩১৫ জনই সদর উপজেলার গৌরীচন্না ইউনিয়নে। যার মধ্যে ইউনিয়নের দক্ষিণ মনসাতলী গ্রামেই ১০৫ জন। ওই এলাকায় এত সংখ্যক ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার বিষয়ে এলাকাবাসীর মতামত জানাতে চাইলে হেমলাল ও ইমরান হোসেন নামে দুজন জানান, এলাকাটি জেলা ও পৌর শহরের সন্নিকটে হওয়ায় খুবই ঘনবসতি এলাকা। তাছাড়া শহরের কাছাকাছি হলেও ইউনিয়নের আওতায় থাকায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার নির্দিষ্ট কোন লোক নেই। ফলে সব সময়ই ময়লা-আবর্জনায় ভরপুর থাকে। অন্যদিকে অসংখ্য ডোবা নালায় পানি আটকে থাকার কারনেই এমন পরিস্থিতি। বরগুনা সিভিল সার্জন অফিসের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১২ জুন পর্যন্ত জেলায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ১ হাজার ৬৩১ জন। বর্তমানে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছে ১৯৩ জন। মুত্যু হয়েছে ৫ জনের। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১ হাজার ৪৩৮ জন। তবে বাসা-বাড়িতে এবং জেলার বাইরে চিকিৎসা নিতে গিয়ে মৃত্যের সংখ্যা অন্তত ১৩ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসেবে ২০২৫ সালের ১ জানুয়ারী থেকে ১১ জুন পর্যন্ত সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৫ হাজার ৩০৩ জন। তার মধ্যে বরগুনা জেলায় ১ হাজার ৪০৬ জন। যা শতকরা হিসেবে ২৬ দশমিক ৫১ ভাগ। অন্যদিকে একই সময়ে বরিশাল বিভাগে আক্রান্তের সংখ্যা ২ হাজার ২৭৫ জন। সে অনুযায়ী বিভাগের মধ্যে শুধু বরগুনা জেলায় আক্রান্ত হয়েছে ৬১ দশমিক ৮০ ভাগ।

বরগুনা জেলায় কেন এত ডেঙ্গু আক্রান্ত:

যেখানে বরগুনার পার্শ্ববর্তী জেলা ঝালকাঠীতে একই সময়ে (১ জানুয়ারি থেকে ১১ জুন) ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ১২ জন, পিরোজপুর ১০৬ জন এবং পটুয়াখালীতে ২৮৫ জন। সেখানে বরগুনায় এত পরিমানে ডেঙ্গু আক্রান্তের বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কিছুই বলতে পারছেন না স্বাস্থ্য বিভাগ। এ বিষয়ে বরগুনার সিভিল সার্জন মোহাম্মদ আবুল ফাত্তাহ্ জানান, হঠাৎ করে কেন বরগুনায় এত ডেঙ্গু আক্রান্ত এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে বলা কঠিন। তবে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনষ্টিটিউট (আইইডিসিআর) ডেঙ্গু বা এ ধরনের রোগের গবেষণামূলক কাজ করেন। তারা হয়তো এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু বলতে পারবেন। তবে শহরের পর্যাপ্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা না থাকা, রোগীদের অসচেতনতা এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী না চলার কারণেও অনেকটা রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বরগুনার ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক ও পৌর প্রশাসক অনিমেষ বিশ্বাস জানান, আমরা শহর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি সর্বাত্তকভাবে চেষ্টা চালাচ্ছি। পাশাপাশি বরগুনা জেলায় এত ডেঙ্গু আক্রান্তের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনষ্টিটিউটকে (আইইডিসিআর) অনুসন্ধানের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে চিঠি দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে বরগুনা ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হওয়া মিজান রানা নামে এক রোগী অভিযোগ করে জানান, ৪ দিন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছি কিন্তু হাসপাতালে একটি নরমাল স্যালাইনও স্টোরে নাই। এমনকি বাজারের কোন ফার্মেসিতেও কিনতে পাওয়া যাচ্ছে না। এ বিষয়ে বরগুনার সিভিল সার্জন জানান, আমাদের ওষুধ ও স্যালাইনের কিছু সংকট আছে। সেগুলো আমরা বিভিন্নভাবে সমাধানের চেষ্টা করছি। তবে সরকারি বরাদ্দ অপ্রতুল থাকায় বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি। 

বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের বরাদ্দ সংকট:

বরগুনা জেনারেল হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ১০০ শয্যা হাসপাতালের জন্য বছরে সরকার বরাদ্দ দেন প্রায় ১১ কোটি টাকা। উক্ত টাকা রোগীদের ওষুধ, খাবার, চিকিৎসা সামগ্রী, জ্বালালি, জনবলের বেতনসহ নানা খাতে ব্যয় হয়ে থাকে। এ টাকা বিভাজন করে রোগীদের খাবার বাবদ (১০০ শয্যা) বছরে বরাদ্দ রাখা হয় ৬৫ লাখ টাকা। যা দিয়ে জনপ্রতি দৈনিক বরাদ্দ থাকে ১৭৫ টাকা। কিন্তু বরগুনা জেনারেল হাসপাতাল ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হলেও এখন পর্যন্ত ১০০ শয্যার বরাদ্দ দিয়েই চালাতে হচ্ছে। যার কারণে ২৫০ শয্যায় রোগীদের খাবার বাবদ বছরে ব্যয় হয় এক কোটি ৬০ লাখ টাকা। অতিরিক্ত ৯৫ লাখ টাকা রোগীদের ওষুধ, চিকিৎসা সামগ্রী ও জ্বালানিসহ নানা খাত থেকে কর্তণ করে রোগীদের খাবারের পিছনে ব্যয় করেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ফলে রোগীদের ওষুধ, চিকিৎসা সামগ্রীসহ নানা খাতে বরাদ্দ প্রয়োজনের থেকে অনেক কম থাকে। অথচ প্রতিদিন বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে অন্তত ৪শ’ থেকে ৫শ’ রোগী ভর্তি থাকে।

বরগুনা ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে জনবল সংকট:

বরগুনা ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসক, নার্সিং সার্ভিস ও অন্যান্য জনবলসহ মোট মঞ্জুরীকৃত পদ রয়েছে ২৩৩ জন। যার মধ্যে বর্তমানে কর্মরত আছে ১২৩ জন, বাকি ১১০টি পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য আছে। এর মধ্যে ৫৫ জন চিকিৎসকের বিপরীতে কর্মরত আছেন ১৬ জন। যার মধ্যে ১০ জন সিনিয়র কনসালটেন্ট এর মধ্যে একমাত্র এ্যানেসথেশিয়া কর্মরত আছে। এছাড়া কার্ডিওলজী, অর্থো সার্জারী, গাইনি, মেডিসিন, পেডিয়াট্রিক, প্যাথলজী, সার্জারী, ইএনটি এবং চক্ষু বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট এর পদ শূন্য। অন্যদিকে, ১২ জুনিয়র কনসালটেন্ট এর বিপরীতে সার্জারী, চক্ষু, কার্ডিওলজী, অর্থো সার্জারী, প্যাথলজী, রেডিওলোজিসহ ৭টি পদ শূন্য আছে। আবাসিক সার্জন ৩ জন এর স্থলে আছে ২ জন। মেডিকেল অফিসার/ সমমান ২৯ জনের বিপরীতে কর্মরত আছে মাত্র ৭ জন। ১০১ জন নার্সিং সার্ভিসের বিপরীতে কর্মরত ৭৯ জন। এছাড়াও হাসপাতালের দৈনন্দিন দাপ্তরিক ও অন্যান্য জনবল ৭৩ জনের বিপরীতে কর্মরত আছে ২৭ জন। যারমধ্যে প্রধান সহকারি, প্রধান সহকারি কাম-হিসাব রক্ষক, স্টোরকিপার, অফিস সহকারি কাম-কম্পিউটার অপারেটর, ডোমসহ গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো শূন্য হয়ে গেছে।বর্তমান ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব জনিত সংক্রমন প্রতিরোধকল্পে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য বৃহস্পতিবার (১২ জুন) ১০ জন সিনিয়র স্টাফ নার্স পদায়ন করেছে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর। এরপর গত ৩ দিনে ১০ জন চিকিৎসকের পদায়ন করা হয়েছে বরগুনায়। এদিকে ডেঙ্গু প্রতিরোধ এবং বরগুনা ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত করাসহ চিকিৎসক পদায়নের দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। এ সময় বক্তারা চিকিৎসা সেবায় ব্যর্থতার জন্য স্বাস্থ্য উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করেন। সূত্র : চ্যানেল২৪.কম 

logo

সম্পাদক ও প্রকাশক : মো. নজরুল ইসলাম