ঢাকায় তীব্র পানি সংকট
নিজস্ব প্রতিবেদক
১০ এপ্রিল, ২০২২, 11:27 AM

নিজস্ব প্রতিবেদক
১০ এপ্রিল, ২০২২, 11:27 AM

ঢাকায় তীব্র পানি সংকট
ছবি : সংগৃহীত
গ্রীষ্মের দাপদাহের সঙ্গে রাজধানীবাসীর পানির চাহিদা বাড়লেও ঢাকা ওয়াসার উৎপাদন কমেছে। এ সময় শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গার পানিতে বেড়েছে দূষণ। এসব পানি পরিশোধন করে খাবার উপযোগী করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। ফলে সায়েদাবাদ ও চাঁদনীঘাট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট থেকে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কম পানি উৎপাদন করা হচ্ছে। একইভাবে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় ও লোডশেডিং বৃদ্ধি পাওয়ায় গভীর নলকূপে পানির উৎপাদনও কমে গেছে। এ অবস্থায় চাহিদার আলোকে প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না ঢাকা ওয়াসা। পাশাপাশি গ্রীষ্ম মৌসুমের শুরুতে ঢাকা ওয়াসার সরবরাহকৃত পানিতে অতিমাত্রায় দুর্গন্ধ দেখা দিয়েছে। চৈত্রের দাবদাহের মধ্যে রোজা রেখে মানহীন পানি নিয়ে চরম বিপাকে রাজধানীবাসী। এছাড়া ওয়াসার পানির পাইপলাইনে স্যুয়ারেজ বর্জ্য ঢুকে পড়া এবং শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গা নদীর পানি দূষণে ব্যবহার উপযোগী থাকছে না। নিরুপায় হয়ে এসব পানি পান করে পানিবাহিত ডায়রিয়াসহ নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছেন নগরবাসী।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে ঢাকা ওয়াসার উৎপাদানক্ষমতার চেয়ে মানুষের পানির চাহিদা বেশি। এজন্য রাজধানীতে তীব্র পানি সংকট দেখা দিয়েছে। বৈশাখে বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত সংকট কাটবে না। কর্তৃপক্ষ এ সত্য জানা সত্ত্বেও তা স্বীকার করছে না। তীব্র গরম, মানুষের পানির ব্যবহার বৃদ্ধি এবং ওয়াসার উৎপাদনক্ষমতা কমে যাওয়ায় নগরবাসীর পানির চাহিদা পূরণ করতে পারছে ঢাকা ওয়াসা। আরও জানা যায়, চাহিদার চেয়ে কম পানি উৎপাদন হওয়ায় সব এলাকায় অল্প পরিমাণ পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। এমনও দেখা যাচ্ছে, কোনো এলাকার পানি দেওয়ার সময় সড়কের সামনের দিকের বাসিন্দারা নিতে নিতে পানি শেষ হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে ওই সড়কের শেষের দিকের বাসিন্দারা পানি পাচ্ছেন না। এসব বাসাবাড়ির বাসিন্দারা জীবনযাপন স্বাভাবিক রাখতে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে ওয়াসার পানির গাড়িতে করে পানি নিয়ে চাহিদা পূরণ করছেন। পানির গাড়ির চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ চাহিদামাফিক সেটাও সরবরাহ করতে পারছে না। বর্তমানে ঢাকা ওয়াসার ৩, ৮, ৯ ও ১০ নম্বর জোনে পানির সংকট বেশি। অর্থাৎ, মোহাম্মদপুর-লালমাটিয়া, উত্তরা, নতুন বাজার-ভাটারা-বাড্ডা, মিরপুরের সেনপাড়া পর্বতা, কাফরুল এলাকার পানি সংকটের মাত্রা প্রকট আকার ধারণ করেছে। এসব জোনের দৈনিক পানির চাহিদা ৮০ থেকে ৮৫ গাড়ি। আর অন্য ৬টি জোনের পানির গাড়ির দৈনিক চাহিদা ৪০ থেকে ৪৫টি। এসব চাহিদা পূরণে হিমশিম খাচ্ছেন ঢাকা ওয়াসার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলী ও কর্মকর্তারা।
ঢাকা ওয়াসার পানি উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত প্রকৌশলীরা জানান, ওয়াসা দৈনিক ২৭০ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করার সক্ষমতা দাবি করলেও বর্তমান গ্রীষ্ম মৌসুমে সেটা হচ্ছে না। সায়েদাবাদ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট-১ ও ২ থেকে স্বাভাবিক সময়ে দৈনিক পানি উৎপাদন হতো ৪৮ কোটি লিটার। বর্তমানে উৎপাদন হচ্ছে ৪২ কোটি লিটার। চাঁদনীঘাট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট থেকে স্বাভাবিক সময়ে ২ কোটি লিটার পানির উৎপাদন হতো, এখন ১ কোটি লিটার উৎপাদন হচ্ছে। ভাকুর্তা প্রকল্প থেকে স্বাভাবিক সময়ে দৈনিক ১৫ কোটি লিটার পানি উৎপাদন হতো। এখন দৈনিক ৪ কোটি লিটার কম উৎপাদন হচ্ছে। পদ্মা (যশলদিয়া) পানি শোধনাগার প্রকল্প থেকে স্বাভাবিক সময়ের মতো ২৭ কোটি লিটার পানি উৎপাদন হচ্ছে। আর ঢাকা ওয়াসার প্রায় ৯০০ গভীর নকলকূপ রয়েছে। সেগুলো থেকে যে পরিমাণ পানি উৎপাদন হতো, এখন এর চেয়ে অন্তত ১০ ভাগ কম উৎপাদন হচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে চলে যাওয়া এবং লোডশেডিংয়ের কারণে উৎপাদন ঘাটতি হচ্ছে। অর্থাৎ, গভীর নলকূপ থেকেও দৈনিক প্রায় ১৬ থেকে ১৭ কোটি লিটার পানি উৎপাদন কম হচ্ছে। এছাড়া ২০ ভাগ সিস্টেম লস হচ্ছে। সে হিসাবে ২৭০ কোটি লিটার পানির মধ্যে দৈনিক ৫৪ কোটি লিটার পানি অপচয় হচ্ছে। এ হিসাব অনুযায়ী, গ্রীষ্ম মৌসুমে ঢাকা ওয়াসায় দৈনিক অন্তত ৮১ কোটি লিটার পানির উৎপাদন কম হচ্ছে।
এছাড়া ঢাকা ওয়াসার হিসাব অনুযায়ী, দৈনিক ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট থেকে পানি উৎপাদন করা হয় ৯১ কোটি লিটার। আর বাকি ১৭৯ কোটি লিটার গভীর নলকূপ থেকে উৎপাদন করা হয়। গ্রীষ্ম মৌসুমে উৎপাদন ৮১ কোটি লিটার হ্রাস পাওয়ায় ঢাকা ওয়াসার বর্তমান দৈনিক পানির উৎপাদন ১৮৯ কোটি লিটার। ঢাকা ওয়াসার হিসাব মতে, বর্তমানে নগরবাসীর পানির চাহিদা ২৪০ কোটি লিটার। এ হিসাবে দৈনিক প্রায় ৫১ কোটি লিটার পানি উৎপাদন কম হচ্ছে। প্রকৌশলীরা আরও জানান, ঢাকা ওয়াসার দাবি-রাজধানীবাসীর পানির চাহিদা দৈনিক ২১০ কোটি লিটার থেকে ২৪০ কোটি লিটার। অর্থাৎ, শীত মৌসুমে নগরবাসীর পানির চাহিদা থাকে ২১০ কোটি লিটার, গ্রীষ্ম মৌসুমে পানির চাহিদা ২৪০ কোটি লিটার। বছরের অন্যান্য সময় এ অবস্থার মাঝামাঝি থাকে। ঢাকা ওয়াসার দাবি অনুযায়ী দৈনিক পানির উৎপাদন সক্ষমতা ২৭০ কোটি লিটার হলে গ্রীষ্ম মৌসুমেও পানির কোনো ঘাটতি হওয়ার কথা নয়। সিস্টেম লস ও উৎপাদন অন্তত ৮১ কোটি লিটার কমে যাওয়ায় এখন নগরবাসীর পানির চাহিদা পূরণে হিমশিম খাচ্ছে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ।
পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, ঢাকা ওয়াসা যে হিসাব বলছে, সে অনুযায়ী পানির উৎপাদন হলে চাহিদা কম। কিন্তু নগরবাসী পানি পাচ্ছেন না। এ দুটো তথ্যের মধ্যে গরমিল রয়েছে কি না, যাচাই করে দেখা যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, পানির উৎপাদন যাই হোক না কেন। যে পানি ঢাকা ওয়াসা সরবরাহ করছে, এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলছেন পানি ফুটিয়ে খেতে হবে। যদি সেটাই হয়, তাহলে এত ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট, এত প্রকল্প বাস্তবায়ন করে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচের প্রয়োজন কী। নগরবাসী নদনদীর পানি ফুটিয়ে খেলেই তো হয়। তিনি আরও বলেন, নিরাপদ পানি মানবাধিকার। এ বিষয় ঢাকা ওয়াসাকে ভুলে গেলে চলবে না। নগরবাসীকে নিরাপদ পানি দেওয়ার অঙ্গীকারে যে পরিমাণ অর্থ খরচ করা হচ্ছে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। আর পানিতে দুর্গন্ধের উৎস চিহ্নিত করে তা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। স্যুয়ারেজের বর্জ্য পানির লাইনে ঢুকে পড়লে আর বলার কিছু থাকে না।
ঢাকা ওয়াসা বোর্ড চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ড. গোলাম মোস্তফা বলেন, ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ আমাদের যে তথ্য দিচ্ছে, সে অনুযায়ী রাজধানীতে চাহিদার চেয়ে পানির উৎপাদন বেশি। আবার প্রতিবছর গ্রীষ্ম মৌসুমে তীব্র পানি সংকট হচ্ছে। এ বিষয়টি নিয়ে আমরা বোর্ড সদস্যরাও বিব্রত অবস্থার মধ্যে পড়ি। উৎপাদন বেশি থাকলে পানি সংকট হওয়ার কথা নয়, এটা স্বাভাবিক হিসাব। এ বিষয়টি আমরা বোর্ড সভায় আলোচনা করব। পানির পাইপলাইনে স্যুয়ারেজ বর্জ্য ঢুকে পড়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ঢাকা ওয়াসার নতুন পাইপলাইন অনেক গভীর দিয়ে করা হচ্ছে। সেখানে স্যুয়ারেজ বর্জ্য ঢোকার সুযোগ নেই। তবে ড্রেনেজ লাইনের সঙ্গে সংযোগ হয়ে থাকতে পারে। আর এটা সত্য যে, ঢাকার ড্রেনেজ লাইনে নগরবাসী পয়ঃবর্জ্য সংযোগ দিচ্ছে। এটা রাজউকের দেখার কথা। কিন্তু তারা এদিকে দৃষ্টিপাত করছে না। এ অবস্থার উত্তরণে ঢাকা ওয়াসারই বা কী করার আছে? তবুও বিষয়গুলোর সমাধানে আমরা বোর্ড সভায় আলোচনা করব।
পানি সংকটে নাকাল নগরবাসী : বাড্ডার খিলবাড়ীর টেকের বাসিন্দারা তিন সপ্তাহ ধরে পানি সংকটে রয়েছেন। গভীর রাত পর্যন্ত তারা পানির জন্য অপেক্ষা করেও স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পানি পাচ্ছেন না। রাত-দুপুরে পাইপলাইনে কিছু পানি এলেও ১ থেকে দেড় ঘণ্টা পর আর পানি থাকে না। এ সময় সবাই তাদের চাহিদামতো পানি সংগ্রহ করতে পারছেন না। এলাকাবাসী জানান, বাড্ডা এলাকায় অবস্থিত ঢাকা ওয়াসা অফিসে এলাকাবাসী অভিযোগ জানালেও কোনো প্রতিকার মিলছে না। পানির লাইনে পানি না পেলেও টাকা জমা দিয়ে পানির গাড়ি মিলছে। পানি সংকটে তারা রমজান মাসে ওজু, গোসল করতে পারছেন না। আর ৩০০ টাকার পানির গাড়ি ৬০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করছেন। বাড্ডার খিলবাড়ীর টেকের বাসিন্দা মো. রমজান আলী বলেন, প্রতিবছর গ্রীষ্ম মৌসুমে বাড্ডা এলাকায় পানির সংকট দেখা দেয়।
১৯০/এ, ফকিরাপুলের বাসিন্দা কাজী সাইফুদ্দিন বলেন, রমজানের ৪ দিন আগ থেকে বাসায় ঢাকা ওয়াসার লাইনের পানি পাওয়া যাচ্ছে না। ফকিরাপুলস্থ ঢাকা ওয়াসা অফিসে যোগাযোগ করে কোনো প্রতিকার মিলছে না। ৯তলা বাড়িতে পানি না পাওয়ায় বাসিন্দারা নাকাল। অনেক চেষ্টা করে দৈনিক ২ গাড়ি করে পানি মিলছে। কিন্তু এতে চাহিদা মিটছে না। রমজানে ওজু, গোসল ও খাবার পানি নিয়ে আমরা খুবই খারাপ অবস্থার মধ্যে আছি। এটা বলে বোঝাতে পারব না। তিনি বলেন, আমরা ঢাকা ওয়াসার ফকিরাপুল অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে বারবার পানি সংকট নিয়ে কথা বলেছি। উনি বলছেন, পানির চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। আমরা তাকে বলেছি, দুই সপ্তাহের মধ্যে এত কী চাহিদা বাড়ল যে সেটা সমাধান করা যাচ্ছে না। জবাবে উনি বলছেন, এখন মানুষ একবারের জায়গায় ২ থেকে ৩ বার গোসল করছে। অন্যান্য পানির ব্যবহারও বেড়েছে। ভারি বর্ষণ হলে এ সংকট কেটে যাবে। এ জবাবে আমরা সন্তুষ্ট হতে পারছি না। -সূত্র: দৈনিক যুগান্তর